শিশুর শেখার গুরুত্বপূর্ণ সময় ৩-৬ বছর

একটি শিশু বড় হলে কেমন হবে তার ভিত্তি তৈরির জন্য তিন থেকে ছয় বছর বয়স খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই সময় পরিবার শিশুকে কিভাবে গড়ে তুলছে, কী শেখাচ্ছে তার উপর নির্ভর করে বড় হয়ে তার বুদ্ধিমত্তা, স্বভাব, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, আচরণ, আত্মবিশ্বাস ইত্যাদি কেমন হবে।

তিন থেকে ছয় বছর বয়সের মধ্যেই সাধারণত একটি শিশুর ব্যক্তিত্বের মূল ভিত্তি গঠন হয়ে যায়।

পরবর্তিতে সমাজ ও শিক্ষা তাকে গড়ার চেষ্টা করলেও এই বয়সে তৈরি হওয়া মূল ভিত্তিগুলো সাধারণত পরিবর্তন হয় না।

এই বয়সে যা ঘটে
শিশুদের বিকাশ নিয়ে পড়াশোনা করেছেন বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক রিয়াজ মোবারক

তিনি বলছেন, শিশুদের জন্মের পর প্রথম এক হাজার দিন এক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

এই সময় শিশুরা দাঁড়ানো, হাঁটা, দৌড়ানো, কথা বলা, কানে শোনা, ঘ্রাণ নেয়া এগুলো শেখে।

এই শেখাগুলোর বহিঃপ্রকাশ করার সুযোগ সে পায় এর পরের ধাপটিতে।

‘এই ধাপটিতে শিশু সরাসরি পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সংস্পর্শে আসতে শুরু করে। সে সমাজের নতুন অনেক কিছুর সাথে পরিচিত হতে শুরু করে। সে স্কুলে যায়। তার যোগাযোগ সৃষ্টি হয়, সংযোগ তৈরি হয়। তার মধ্যে কোনো কিছু সম্পর্কে ধারণার জন্ম হয়। এসব গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছু ঘটে তিন থেকে ছয় বছর বয়সে,’ বলছিলেন অধ্যাপক মোবারক।

তিনি বলছেন, পরিবারের বাইরে অন্য প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি ও শিশুদের প্রতি তার মনোযোগ তৈরি হয়।

এ সময়টিতে সে স্বাধীন আচরণ শুরু করে। নতুন কিছু নেড়েচেড়ে দেখা, জানতে চাওয়া শুরু হয়।

এই সময়টাতে ভাল বা মন্দ যা কিছুর সাথে তার পরিচয় হবে, পরিবারে অন্যদের সম্পর্কের মধ্যে কী ঘটছে, তাদের আচরণ কেমন, চারপাশে কী হচ্ছে, পরিবারের অভাব অথবা প্রাচুর্য, এই সব কিছুর উপর নির্ভর করবে শিশুটি ভবিষ্যতে কেমন মানুষ হবে।

অধ্যাপক মোবারক বলছেন, এই সময়ে শিশু যদি সঠিক খাবার, খেলাধুলার সুযোগ না পায়, বেড়ে ওঠার পরিবেশ যদি সুস্থ না থাকে তাহলেও তার শরীর ও মস্তিষ্কের বৃদ্ধি সঠিকভাবে হবে না।

সেটিও তার বুদ্ধির বিকাশে প্রভাব ফেলবে।

মা-বাবার উপর যা নির্ভর করে
ঢাকার মিরপুরের বাসিন্দা রাহেলা আকতার সম্প্রতি তার চার বছর বয়সী মেয়ের আচরণ নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছিলেন।

বাইরে গেলেই সে কিছু একটা কিনতে চায়, বিশেষ করে খেলনা।

‘রাস্তা দিয়ে গেলেই তার চোখ পড়বে খেলনার দোকানে। সেটা হয়ত স্বাভাবিক। কিন্তু ওষুধের দোকান, মুদি দোকান, ডিপার্টমেন্ট স্টোর এমনকি রাস্তার পাশের খেলনার দোকান এরকম অনেক জায়গা থেকে প্রতিবার তাকে কিছু না কিছু কিনে দিতেই হবে। বিষয়টা এমন দাঁড়ালো যে কিছু একটা না কিনে দিলে সে লোকজনের সামনে, রাস্তাঘাটে পারলে কান্নায় গড়াগড়ি খায়। আমরা তখন কী করবো বুঝে উঠতে না পেরে কিছু একটা কিনে ফেলি,’ বলছিলেন রাহেলা আকতার।

শিশুদের এমন আচরণ নিয়ে তিনিঅনলাইনে পড়া শুরু করলেন। কারণ রোজরোজ খেলনা কিনে দেয়া তার পক্ষে যেমন সম্ভব নয়, তেমনি এই আচরণ যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় তা নিয়ে উদ্বেগ বোধ করছিলেন তিনি।

এক পর্যায়ে একটি সমাধানও তিনি বের করেছেন।

‘আমি পড়ছিলাম শিশুদের জন্য পুরস্কার ব্যবস্থা চালু করা সম্পর্কে। কোনো কিছু ভাল করলে তাকে পুরস্কার দেয়া। যদি সে তার খেলনাগুলো গুছিয়ে রাখে, ঘর এলোমেলো না করে, আমাকে একটা কিছু করতে সাহায্য করে, সহজ কিছু যেটা সে পারবে, এরকম কিছু কাজের জন্য তাকে পুরস্কার দেয়া হবে। তা না হলে এসব খেলনা পুরস্কার তাকে কিনে দেয়া হবে না, এভাবে বলা শুরু করলাম। ধীরে ধীরে দেখলাম সে সেটা করা শুরু করলো।’

‘সে তার খেলনা কারো সাথে শেয়ার করবে না। আমি এবার ওর জন্মদিনে ওকে বস্তির বাচ্চাদের একটা স্কুলে নিয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে ওকে দেখাতে চেয়েছিলাম যে ওদের কিছুই নেই। ওদের কিছু খেলনা দিয়েছিলাম। সে সেটা সেদিন পছন্দ করেনি। কিন্তু পরে বুঝেছে যে খেলনা শেয়ার করলে অন্য শিশুরা তার সাথে খেলবে।’

রাহেলা আকতার আচরণ বিজ্ঞানে ডিগ্রিধারী নন। তবে ধীরে ধীরে শিখছেন।

শিশুর বৈশিষ্ট্য তৈরি করার ব্যাপারে মা-বাবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা বলছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের শিক্ষক, সাইকোথেরাপিস্ট নুজহাত ই রহমান। তিনি শিশুদের কাউন্সেলিং নিয়ে কাজ করেন।

শিশুর ব্যক্তিত্ব, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য গঠনে মা-বাবা কীভাবে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারেন, সে ব্যাপারে তিনি কিছু পরামর্শ দিয়েছেন।

‘শিশু কোনো কিছু করতে চাইলে, যেমন- সে গ্লাস নিজে ধরে পানি খেতে চাইছে, বাবা মায়েরা ভাবেন সে ছোট, সে ব্যাথা পাবে, কিছু ভেঙ্গে ফেলবে, পারবে না এসব চিন্তা থেকে তাকে সবসময় না বলার প্রবণতা ছাড়তে হবে। এভাবে কিছুই না করতে দিলে তার মধ্যে নিজের ক্ষমতা নিয়ে দ্বিধা তৈরি হবে। সে ভাববে আমি বোধহয় আসলেই পারি না। এটা তার আত্মবিশ্বাস নষ্ট করবে।’

নিজের উপর বিপদ ডেকে না আনলে তাকে কিছু কাজ করতে দিতে হবে।

নিজের হাতে খেতে দিলে কিছু খাবার যদি ফেলেও দেয় তবুও তাকে সেটি করতে দেয়ার কথা বলছেন এই শিক্ষক যাতে তার মধ্যে ‘আমি পারি’ এই আত্মবিশ্বাস ও স্বাধীনতাবোধ তৈরি করা যায়।

‘বারবার কিছুই করতে না দিলে কিছু শিশুরা আছে যারা পরবর্তীতে কখনোই আর সেটা করার চেষ্টাই করে না। তাই সে সেই কাজটি পরে সঠিকভাবে করতে শেখে না। এটি শুধু খাওয়া নয় অন্য সব কিছুর ব্যাপারে প্রযোজ্য।’

শিশুকে কিছু পছন্দ করতে দিতে হবে, তার মতামত জানতে চাইতে হবে।

যেমন দোকানে তাকে জামা বা জুতা কেনার সময় জিজ্ঞেস করতে হবে এটি তার পছন্দ হয়েছে কিনা।

সে এতে তার মতামতকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে বল মনে করবে। এতে তার সিদ্ধান্ত নেয়ার সক্ষমতা বাড়বে।

অন্য শিশুদের সাথে খেলাধুলায় উৎসাহিত করলে সে সামাজিক হয়ে উঠবে।

তাকে সারাক্ষণ সব কাজে সাহায্য না করে সমস্যা সমাধান করতে দিতে হবে।

নিয়মিত সাথে বসে বই পড়ায় ভাষার দক্ষতা বাড়বে।

খাবার টেবিলে শিশুকে একসাথে নিয়ে খেতে বসলে সব ধরনের খাবারে আগ্রহ হবে।

শিশুকে ছোটবেলায় নিরাপদ পারিবারিক পরিবেশ না দিতে পারলে, তাকে সারাক্ষণ বকাঝকা মারধোর করায় সে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে, ভিতু হয়ে উঠবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *